আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল: (১ জানুয়ারি ১৯৫৬ - ২২ জানুয়ারি ২০১৯) বাংলাদেশের একজন সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব যিনি একাধারে গীতিকার, সুরকার এবং সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন। ১৯৭০-এর দশকের শেষ লগ্ন থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পসহ সঙ্গীত শিল্পে সক্রিয় ছিলেন। ১৯৭১ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
সঙ্গীতে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সম্মান একুশে পদক, শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে দুইবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং রাষ্ট্রপতির পুরস্কার-সহ অন্যান্য অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হন।
প্ররম্ভিক জীবন
ইমতিয়াজ বুলবুল ১৯৫৬ সালের ১ জানুয়ারি ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ওয়াফিজ আহমেদ ও মাতার নাম ইফাদ আরা নাজিমুন নেসা। ঢাকার আজিমপুরের ওয়েস্টটেন্ট উচ্চ বিদ্যালয়ে তিনি মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন এবং শিক্ষাজীবনে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ
ইমতিয়াজ বুলবুল ছাত্রজীবনে মাধ্যমিকে অধ্যয়নরত অবস্থায় মাত্র ১৫ বছর বয়সে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেন। এসময় তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের ২ নাম্বার সেক্টরে মেজর আবু তাহের মোহাম্মদ হায়দারের অধীনে যুদ্ধ করেন। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অপারেশন সার্চলাইটের পর বুলবুল ও তার বন্ধুরা মিলে পাকিস্তানিদের কাছ থেকে অস্ত্র ছিনতাই করে ছোট একটি মুক্তিযোদ্ধা দল গঠন করেন যাদের ঘাঁটি ছিল ঢাকার জিঞ্জিরায়। জুলাইয়ে বুলবুল ও তার বন্ধু সরোয়ার মিলে নিউ মার্কেটের ১ নাম্বার প্রবেশমুখের কাছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর লরিতে গ্রেনেড হামলা করেন। অগস্টে ভারতের আগরতলায় কিছুদিন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং ঢাকায় ফিরে ‘ওয়াই (ইয়াং) প্লাটুন’ নামে একটি গেরিলা দল গঠন করেন।
অক্টোবরে পুনরায় ভারত যাওয়ার সময় বুলবুলসহ চারজন কুমিল্লা এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাঝামাঝি তন্তর চেকপোস্টে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে আটক হন। আটক হওয়ার পর প্রথমে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কারাগারে ও পরে এ অঞ্চলের শান্তি কমিটির প্রধান কার্যালয়ে নির্যাতনের শিকার হন। পরবর্তীতে বয়সে ছোট হওয়ায় তিনি মুক্তি পান কিন্তু ঢাকায় তার নিজ বাসা থেকে পুনরায় গ্রেফতার হন ও জাতীয় সংসদের মানিক মিয়া এভিনিউ'র এমপি হোস্টেলে নির্যাতনের শিকার হন । সেখান থেকে তাকে রমনা থানায় স্থানান্তর করা হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিজয়ী হওয়ার পর মুক্তিবাহিনী রমনা থানা থেকে আহতাবস্থায় তাকে উদ্ধার করেন। পরবর্তীতে তাকে পিজি হাসপাতালে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) চিকিৎসা প্রদান করা হয়।
যুদ্ধাপরাধের সাক্ষী
২০১২ সালের আগস্টে ইমতিয়াজ বুলবুল বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে দন্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রদান করেন। পরবর্তীতে ২০১৩ সালের ৯ মার্চ রাতে ঢাকার কুড়িল উড়ালসেতুর পাশ থেকে পুলিশ বুলবুলের ছোট ভাই আহমেদ মিরাজের লাশ উদ্ধার করে। তার ভাইয়ের মৃত্যুর পর তিনি সরকারের কাছে তার নিরাপত্তা বৃদ্ধির আবেদন করেন এবং এটাও উল্লেখ করেন যে সাক্ষ্য দেওয়ার পর তিনি বেশ কিছু হত্যার হুমকি পেয়েছেন।
সঙ্গীত জীবন
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল ১৯৭৬ সাল থেকে সাল থেকে নিয়মিত গান করেন। ১৯৭৮ সালে মেঘ বিজলি বাদল ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনার মাধ্যমে চলচ্চিত্রে কাজ শুরু করেন। ১৯৮৪ সালে বেলাল আহমেদের পরিচালিত নয়নের আলো চলচ্চিত্রের গীত রচনা ও সঙ্গীত পরিচালনা করেন তিনি। সেই চলচ্চিত্রের তার লেখা ‘আমার সারাদেহ খেয়োগো মাটি’, ‘আমার বাবার মুখে’, ‘আমার বুকের মধ্যেখানে’, ‘আমি তোমার দুটি চোখের দুটি তারা হয়ে’ গানগুলো জনপ্রিয়তা পায়।
তিনি স্বাধীনভাবে গানের অ্যালবাম তৈরি করেছেন এবং অসংখ্য চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন। তিনি সাবিনা ইয়াসমিন, রুনা লায়লা, সৈয়দ আব্দুল হাদি, এন্ড্রু কিশোর, সামিনা চৌধুরী, খালিদ হাসান মিলু, জেমস, খান আসিফুর রহমান আগুন, কনক চাঁপা, মনির খান-সহ বাংলাদেশী প্রায় সকল জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পীদের নিয়ে কাজ করেছেন। বুলবুল সঙ্গীত প্রতিভা অন্বেষণে বাংলাদেশের রিয়েলিটি অনুষ্ঠান ক্লোজআপ ওয়ানের তিন মৌসুমে বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
মৃত্যু
তিনি দীর্ঘদিন ধরে হৃদযন্ত্রের জটিলতায় ভুগছিলেন। হৃদপিণ্ডে ব্লক ধরা পড়ায় ২০১৮ সালে বাংলাদেশের জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে তার হৃদপিণ্ডে অস্ত্রোপচারও করা হয়। পরে ইমতিয়াজ বুলবুল ২০১৯ সালের ২২ জানুয়ারি মঙ্গলবার ৬৩ বছর বয়সে ঢাকার আফতাবনগরে তার নিজ বাসায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন ।